অনিক ভাই এর চা বাগান শুরুর আগে, গরু ছিল ৫৩ টা ।
দুধের গরু ছিল সব এবং বেশিরভাগই ফ্রিজিয়ান গরু । পঞ্চগড়ের শীতে গরুগুলি ভালভাবেই থাকত ।
প্রতিদিন ২০০ লিটার দুধ মিল্ক ভিটায় দিতেন, বিক্রির জন্য সমস্যা হত না । গরুগুলি উনি ২০০৯ সাল থেকে গড়ে তুলেছিলেন । এই সময়ে করা কস্ট, ২০১৩ তে এসে হরতাল আর অবরোধে ভেসে গেল ।
সেসময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে প্রায় ৩ মাস অবরোধ চলেছে, গাড়ি পুড়েছে রাস্তায় (কারা পুড়িয়েছে সে তর্কে না যাই) । এই কারনে, পরিবহন বন্ধ থাকায় মিল্ক ভিটা দুধ কেনা বন্ধ করে দেয় ।
এদিকে, প্রতিদিন গরুকে ঠিকই খাওয়াতে হয়, দুধ দোয়াতে হয় এবং বাজারে নিয়ে ১০টাকা লিটারও বিক্রি না হওয়ায় নাগরী নদে ভাসিয়ে দিতে হয় ।
২০০৯ থেকে গড়ে তোলা ডেইরি ফার্ম – ৩ মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুরোই নস্ট হয়ে যায় । তিনি কিছুটা লসে হলেও গরুগুলি বিক্রি করে দেন, খামার খালি করে ফেলেন ।
এরপরে শুধু গরু মোটা তাজাকরন করেই উনি গরু পেলেছেন, এবং পরে মহিষ পালা শুরু করেন । আমি যখন প্রথম উনার অইখানে যাই – তখন উনার ৪ টি মহিষ ছিল, এর মাঝে একটা মুররাহ জাতের । যে মহিষ ১৩/১৪ লিটার দুধ দিত । মুররাহ জাতের মহিষ বাংলাদেশে সম্ভবত কারো কাছে আছে বলে আমার জানা নাই ।
তাহলে, ডেইরি ফার্ম করাটা কি ভুল ?
এখানে কি বেশি ঝুকি ?
উত্তর হ্যা, গরু মোটাতাজা করার চাইতে, ডেইরি ফার্ম এ ঝুকি তুলনামূলক বেশি ।
এটাকে এভাবে উদাহরন দেয়া যায়ঃ একজন নারির জীবনে সবচেয়ে জটীল সময় হল যখন সে মা হয় । এ সময়ে তার আলাদা যত্ন, আলাদা খাবার, পুস্টী সব কিছুই বেশি বেশি লাগে ।
ডেইরি ফার্ম একটি ম্যাটার্নিটি হোম এর মত, যেখানে সবসময় আলাদা যত্নের দরকার হয় ।
ডেইরি ফার্ম করার আগে, কিছু বিষয় জেনে নিলে ভাল হয় ।
১/ আপনার এলাকায় দুধের পাইকারি কত ? ৩০? ৪০? তাহলে সম্ভবত আপনার এলাকায় বাণিজ্যিক দুধের খামার না করাই ভাল । ৫০ এর নিচে হলে আসলে খরচ পুষিয়ে দুধের বাণিজ্যিক খামার লাভজনক করা কঠিন ।
২/ আপনার গরুর দুধ ১৫ লিটারের নিচে হলেও লাভ করাটা কঠিন হয়ে যায় । কিন্তু ১৫ লিটার এর এক্টী ভাল জাতের গরু বাজারে পাওয়া খুবই কঠিন কারন এমন ভাল গরু সাধারনত কোন খামারি হাত ছাড়া করেন না ।
এজন্য এমন গরু বানিয়ে নিতে হয় জাত উন্নয়ন করে । অর্থাৎ, ১০ লিটারের গরু কিনে সেটা থেকে বকনা বাছুর নিয়ে, সেখানে আরো ভাল জাতের গরুর বিজ দিয়ে পরেরটাও যদি বকনা হয় তাহলে তার দুধের পরিমান বাড়বে ।
এখানে কিছু শেখার বিষয় আছে, আমাদের দেশে গরুর % হিসাব করে বিজ দেয়া হয়, মানে কোন গরুর % বেশি সেটা ভাল হবে এমন ভাবা হয় । অথচ উচিত হল – কোন ষাঁড়ের মা নানি দাদি বেশি দুধ দিত এমন গরুর বীজ দেয়া ।
৩/ ইনব্রিডীং নিয়ে ভাল ধারনা রাখা জরুরি । ইনব্রিডীং হল – ধরা যাক এক গরুকে স্থানীয় এআই ( কৃত্রিম প্রজনন কর্মী) বিজ দিল । ২ বছর পর এই বিজ থেকে যে গাভি হল – তাকেও একই ষাড়ের বিজ দিল কারন তার কাছে বা খামারির কাছেও কোন রেকর্ড নাই যে এই গাভিটি অই ষাড়েরই মেয়ে । অর্থাৎ, ইসলাম ধর্মে যে মাহরাম এর কথা বলা হয়, মানে যাদের সাথে বিবাহ সম্পর্ক হারাম তার বিজ গাভিকে দেয়া যাবে না ।
এটাকেই ইনব্রিডিং বলে ।
ইনব্রিডীং এর কারনে, পরের গাভি বিকলাংগ, কম দুধ দেয়া, অসুস্থ্য বেশি হয় । গত ৪০ বছরে আমাদের দেশে কোন রেকর্ড না থাকার কারনে গরুর জাতের উন্নয়ন না হয়ে অবনতি হয়েছে ।
ইনব্রিডীং সমস্যার কারনেই, মিশরের ফেরাউন বংশের পতন ও বিনাশ হয়েছিল কারন তাদের ভাই বোনের মাঝে বিয়ে হত ।
৪/ইনব্রিডীং এড়ানর জন্য রেকর্ড রাখা জরুরি ।
৫/ জাত উন্নয়ন নিয়ে জানতে হবে খুব ভালভাবে –
মানে হলঃ আপনার গরু দুধ দেয় ১০ লিটার, এটাকে আপনি এমন ষাড়ের বিজ দিলেন যার মা নানি ১৮ লিটার দুধ দেয় । এই বিজ থেকে যে গাভি পাওয়া যাবে সেটা আশা রাখা যায় ১৪/১৫ লিটার দুধ দেবে ।
এই গাভিকে ইনব্রিডীং মুক্ত থেকে যদি ২৫/২৮ লিটার দুধ দেয় এমন ষাঁড়ের বিজ দেয়া হয় তাহলে এই গাভির বকনাও পরের বারে দুধ বেশি দেবে ।
৬/ জাত উন্নয়ন যেহেতু বার বার বিজ দিয়ে করতে হয়, কাজেই এখানে ৬/৭ বছর লেগে যায় ভাল জাতের গাভির পাল তইরি করতে । এই ধইর্য থাকতে হবে ।
৭/ ডেইরি ফার্ম শুধু দুধ বিক্রির উপরে নির্ভরশীল না হয়ে বাই প্রোডাক্ট তইরি করতে পারলে টীকে থাকা সহজ হয় । বাই প্রোডাক্ট বলতে, মিস্টী, ঘি, মজারেলা চিজ এগুলো বানিয়ে নিজে বাজারজাত করতে পারলে লাভ অনেক ভাল আসে ।
৮/ গরুর গোবর থেকে খুব ভাল সার হয় – সেটা ভার্মি কম্পোস্ট হোক বা ট্রাইকো কম্পোস্ট। এই গোবর সার করতে পারলে খামারের খরচ অনেকটাই কমে আসে । আর খরচ কমা মানেই হল সেটাই লাভ ।
৯/ কাচা ঘাস জরুরি গরুর জন্য – স্থায়ী ঘাসের জন্য জমিতে পাকচং জাতের ঘাস থাকা জরুরি ।
১০/ পড়া ভুলে গেছি, আর মুখস্ত নাই, মনে পড়লে লিখবো – মাইর দিয়েন না ।
ভাল গরু কেনাটাও খুব জরুরি বিষয় । গরু কিনতে গিয়ে তাড়াতারি করলে ভুল হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় । কেউ যদি মনে করে, হাটে যখন গেছি, গরু কিনেই ফিরবো তাহলে ঠকার সম্ভাবনা বেশি ।
গরুর দুধের রেকর্ড জানার জন্য, ১ দিন গরু বিক্রেতার বাড়িতে থাকতে পারলে সবচে ভাল । বিকেল এ কত দুধ দিল এবং পরদিন সকালে কত দুধ দিল এটার গড় করতে হবে । অনেকে অসাধু খামারি আছে যারা দুধ জমিয়ে রাখে ২/৩ দিন । এরপর সামনে দুধ দুইয়ে দেখায় দুধ হয়েছে ১৫ লিটার ।
এরপর বাড়িতে নিয়ে এসে দেখা যায় সেই গরু দুধ দিচ্ছে ১০ লিটার ।
গরুর দাম নিয়েও হিসাব আছে, দুধের গরু প্রতি লিটার ১০০০০ বা এর কাছের দামে বিক্রি হয় । মানে যে গরু দুধ দিচ্ছে ১৫ লিটার তার দাম ১৫০০০০ হওয়া উচিত, অনেক ব্যাপারি এর সাথে গরুর ওজনের দামও চেয়ে বসে ।
এখানে অনেক খুটিনাটি বাদ গেল, আসলে অনেক বড় হয়ে যাবে লিখতে গেলে ।
পরের বা অন্য কোন পোস্টে আরো আলোচনা করা যাবে ।